আরো অনেক দেশের মত বাংলাদেশ হচ্ছে নানা প্রজাতির বাদুড়ের প্রাকৃতিক
আবাস। বাদুড় স্তন্যপায়ী প্রাণি বলে মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী
প্রাণির কোষ এবং শরীরের নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাদুড়ের কোষ এবং
শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অনেকখানি মিল রয়েছে। একইসঙ্গে বাদুড় উড়তে পারে
বলে সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রাণিদের তুলনায় বাদুড়ের চলাচলের ক্ষেত্র
অনেকটা বেশি বিস্তৃত। বাদুড় এমনিতে চমৎকার প্রাণি। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত,
বাদুড় অনেকগুলো ভাইরাসের বাহক। তার মানে হচ্ছে, বাদুড়ের শরীরে অনেকগুলো
ভাইরাস বাসা বেধে থাকে এদেরকে মেরে না ফেলেই। যেহেতু বাদুড়ের সঙ্গে
মানুষের কোষ এবং শরীরের নানা প্রক্রিয়ার দারুণ মিল রয়েছে, সেজন্য
বাদুড়ের শরীরের থাকা ভাইরাস সহজে মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। বস্তুত,
বাদুড়ের শরীরে থাকা কয়েকটা ভাইরাস মানুষের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে।
যে বাদুড়দের কথা বলতে চাইছি এরা Pteropodidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত
বিশেষত Pteropus গণের বিভিন্ন প্রজাতি (অন্তত ৬০টি প্রজাতি রয়েছে)।
ইংরেজিতে এদেরকে বলে fruit bat, কখনো কখনো বলে flying fox। বাংলায় আলাদা
নাম আছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু এদেরকে সহজেই আলাদা করে চিনতে পারা
যায় এদের শেয়ালের মুখের মত মুখ দেখে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি,
শত্রুর প্রতি এরা সজ্জন নয়।
এই বাদুড়েরা যে ভাইরাসগুলো বয়ে বেড়ায় সেগুলোর একটি হচ্ছে নিপাহ
ভাইরাস। নিপাহ ভাইরাস মানুষের মস্তিস্কে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই ভাইরাসের
সংক্রমণে যে রোগ হয় সেটাকে বলে এনসেফালাইটিস। জেনে রাখা ভালো, বিশেষ ধরনের
মস্তিস্কের সংক্রমণ মানেই এনসেফালাইটিস। সেজন্য কোন জীবাণুর সংক্রমণে
এনসেফালাইটিস হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে রোগ কতটা মারাত্মক হবে। নিপাহ
ভাইরাস জনিত যে এনসেফালাইটিস, সেটি খুবই মারাত্মক। নিপাহ জনিত
এনসেফালাইটিসে মৃত্যুর হার কমবেশি ৭৫ শতাংশ। তারমানে একশোজন লোক এই ভাইরাসে
আক্রান্ত হলে ৭৫ জনই মারা যায়। বাংলাদেশে যতবার নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ
হয়েছে তারমধ্যে অন্তত দু’বার এর সংক্রমণে মৃত্যুর হার ছিল ১০০ ভাগ।
নিপাহ ভাইরাসের বিষয়টি আমাদের, মানে বাংলাদেশের মানুষদের জন্য বেশি
গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, ভাইরাসটি সনাক্ত হবার পর থেকে দুয়েকটি ব্যতিক্রম
ছাড়া এটি কেবল বাংলাদেশেই সংক্রামিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ভাইরাসের বাহক
বাদুড়ের বিস্তীর্ণ আবাস বলে, বিশেষত বাংলাদেশের মানুষেরা এই ভাইরাস
সংক্রমণের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
তালিকা তৈরি করে লিখতে আমি স্বচ্ছন্দ্য নই। কিন্তু পাঠকেরা যাতে খুব
সহজে মূল তথ্যটুকু পেতে পারেন সেজন্য একটা তালিকা তৈরির চেষ্টা করি।
# কী রোগ হয়?
এনসেফালাইটিস। বলা যেতে পারে মস্তিস্কে ভাইরাসের সংক্রমণ। একই সঙ্গে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণও হতে পারে।
# কোন প্রাণি থেকে ছড়ায়?
বাদুড়। যে বাদুড়ের মুখ শেয়ালের মত সেইসব বাদুড় হচ্ছে এই ভাইরাসের
বাহক। তবে কোন মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে (এমনকি মৃত্যুর পরেও) তার
থেকে অন্যদের মাঝে এই ভাইরাস সংক্রামিত হতে পারে। গৃহপালিত স্তন্যপায়ী
প্রাণিদের মাঝেও নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে দেখা গেছে।
# কীভাবে ছড়ায়?
সাধারণত বাদুড়ের শরীর থেকে নির্গত যেকোন পদার্থ (লালা, মল-মুত্র) থেকে
এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। বাদুড়ের লালা বা মলমূত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে
বিশেষত খেজুরের রসে এই ভাইরাসটি মিশে যায় বলে সংক্রমণ বিশেষজ্ঞরা মনে
করেন। সেই খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাস মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে।
একইসঙ্গে বাদুড়ের সংস্পর্শে এসেছে এমন ফল সবজি ইত্যাদি খাদ্যউপাদান থেকেও নিপাহ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
#রোগের লক্ষণ কী?
মাথাব্যথা, জ্বর, মাংসপেশীর খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, শরীরের উপর
নিয়ন্ত্রণহীনতা, গলা ফুলে যাওয়া, বমি, জ্ঞান হারানো, প্রলাপ বকা, এরকম
অসংখ্য উপসর্গ দেখা যেতে পারে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে। সাধারণের এই
উপসর্গগুলো নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। কিন্তু চিকিৎসকরা সহজেই
এনসেফালাইটিসের উপসর্গ বুঝতে পারবেন। যেহেতু বাংলাদেশের সাধারণ হাসপাতালে
কোনো এনসেফালাইটিস নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে হয়েছে কিনা তা দ্রুত নিশ্চিত
হওয়ার উপায় নেই, সেজন্য এনসেফাইটিসের সকল রোগীকেই সাধারণ রোগীদের থেকে
আলাদা রেখে সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যতক্ষণ না এনসেফালাইটিসের কারণ
সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে।
#সতর্কতা?
বাদুড়ের সংস্পর্শে এসেছে এমন কোনকিছু খাওয়া যাবেনা। বিশেষত খেজুরের রস
খেতে হলে তা অন্তত ৫ মিনিট সিদ্ধ করা হয়েছে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মনে
রাখুন, ৫ মিনিট সিদ্ধ করা মানে জ্বলন্ত চুলায় কোন তরল ৫ মিনিট রেখে তারপর
নামিয়ে নেয়া নয়। এর মানে হচ্ছে, কোন তরল ফুটতে শুরু করলে ফুটন্ত
অবস্থায় ৫ মিনিট রেখে তারপর নামিয়ে নেয়া। খেজুরের রস যদি পরিষ্কার না
হয় অথবা তার সঙ্গে যদি কোন শক্ত উপাদান মেশানো থাকে তাহলে তা অন্তত ২০
মিনিট সেদ্ধ করে নেয়া ভালো।
গ্রামে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই সতর্ক থাকবেন কোন পাখির
আঁচড়/কামড়ের দাগওয়ালা ফল খাওয়ার সময়। সন্দেহ হলে এরকম ফল না খাওয়াই
ভালো। আমি আতঙ্ক ছড়াতে চাইছিনা। কিন্তু এই ভাইরাসটি সম্পর্কে খুব বেশি
গবেষনা করা হয়নি। আমি কোথাও খুঁজে পাইনি মুক্ত (আদ্রতাশূন্য অথবা আদ্র)
পরিবেশে এই ভাইরাসটি কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে। ফলে বাদুড়ে কামড়ানো ফল থেকে
এই ভাইরাস মানুষের মাঝে সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাব্যতা আসলে কতটুকু তা-ও
আমার জানা নেই। আমি জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এসম্পর্কিত কোন গবেষণাপত্র
আমি পাইনি। সেজন্য, এইক্ষেত্রে আমি নিজে যা করতাম, আপনাদেরকেও তা-ই করতে
পরামর্শ দিচ্ছি। বাদুড়ের কামড়ের দাগ আছে সন্দেহ হলে, ফলটি ফেলে দিন। সেটি
যদি ভালোমত সিদ্ধ করে রান্না করা হয় তাহলে খেতে পারেন। কিন্তু কাঁচা
খাবেন না।
শ্রদ্ধেয় ব্লগার ষষ্ট পাণ্ডবের মন্তব্য থেকে যোগ করে দিচ্ছি, গ্রামের
শিশুদের মাঝে বিশেষত পেয়ারা গাছ থেকে পেড়েই খেয়ে ফেলার অভ্যেস দেখা
যায়। এইসব পেয়ারা বাদুড়ের সংস্পর্শে এসে থাকতে পারে এবং এ থেকে নিপাহ
ভাইরাস সংক্রমণেরও সম্ভাবণা রয়েছে। বাদুড় খোসার উপর দিয়ে কলা চুষে খেতে
পারে। এতে সৃষ্ট হওয়া কালো দাগকে ফলবিক্রেতারা পরিবহনজনিত কারণে সৃষ্ট দাগ
বলেন। কলায় পরিবহনের সময় কালো দাগ তৈরি হতে পারে অবশ্যই কিন্তু আবার
বাদুড়ের কারণেও কালো দাগ তৈরি হতে পারে। যেহেতু কলা খোসা ছাড়ানোর পর
ধুয়ে অথবা সেদ্ধ করে খাওয়ার উপায় নেই তাই কলায় কালো দাগ থাকলে একশোভাগ
নিশ্চিত হয়ে নিন সেটি বাদুড়ের কারণে হয়েছে কিনা।
এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাবেন না। যাঁরা চিকিৎসক অথবা
রোগীর সেবায় নিয়োজিত তাঁরা যাবেন পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করে তারপর।
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি অথবা শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে
বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অদৃশ্য ক্ষুদ্র জলকণার মাধ্যমেও নিপাহ ভাইরাস ছড়াতে
পারে। সেজন্য রোগীর সেবার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
যেহেতু বাংলাদেশ দারুণভাবে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে
সেহেতু এই ভাইরাসটির উচ্চতর গবেষণার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আমার জানামতে
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের উপর যে গবেষণাগুলো হয়েছে সেগুলো সবই
‘এপিডেমিওলজিকাল রিসার্চ’। বলা যেতে পারে মহামারী সংক্রান্ত গবেষণা।
দূর্ভাগ্যজনকভাবে নিপাহ ভাইরাসের উপর সারা পৃথিবীতেই মৌলিক গবেষণা হয়েছে
খুবই কম। গবেষণার উদ্যোগ প্রয়োজন, দ্রুত। ঠিক যেমন অস্ত্র কেনার আগে
আমাদের শিক্ষকদের বেতন দেয়া প্রয়োজন, তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া
প্রয়োজন।
সবার আগে যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে মানুষকে সতর্ক করা। আমি যেহেতু দেশে
থাকিনা, তাই আমার স্পষ্ট জানা নেই আমাদের দেশের মানুষ এই ভাইরাসটির সংক্রমণ
বিষয়ে কতটা সচেতন। পর্যাপ্ত সচেতন নয় বলেই জেনেছি। সেরকম হলে, সচেতন করা
প্রয়োজন। দূর্ভাগ্যবশত এই লেখাটি গ্রামের সেইসব মানুষের কাছে পৌঁছবে না
যাঁরা সরাসরি নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমনের ঝুঁকিতে রয়েছেন। কিন্তু আমি জানি,
আপনারা যাঁরাই এই লেখাটি পড়ছেন সবাই কোন না কোনভাবে গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক
রাখেন। আমি নিজে যা করেছি, সেটি আপনাদেরকেও অনুরোধ করি। গ্রামে স্বজনরা
যাঁরা রয়েছেন তাঁদেরকে আজকেই একটি ফোন করে সতর্ক করুন। তাদেরকে বুঝিয়ে
বলুন নিপাহ ভাইরাস কী এবং এটা কীভাবে ছড়ায়। তাঁদেরকে জানিয়ে দিন কীভাবে
সতর্ক থাকতে হবে। স্বজনদের প্রতি এটুকু দায়বদ্ধতা বোধহয় আমাদের থাকা
উচিত।
আমি নিজের লেখা শেয়ার করতে কাউকে অনুরোধ করিনা। কিন্তু এই লেখাটি
শেয়ার করতে অনুরোধ করছি। আপনি চাইলে এই লেখার যেটুকু অংশ প্রয়োজনীয় মনে
হয় সেটুকু শেয়ার করতে পারেন। চাইলে প্রয়োজনিয় অংশ আলাদাভাবে কপি করে
প্রকাশ করতে পারেন। লেখকের নাম দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। শুধু মানুষকে
সতর্ক করলেই হবে।
অনেকখানি ব্যস্ত আছি, সেইজন্য যতটা সম্ভব দ্রুত লিখতে চেষ্টা করেছি। আমার
জানার পরিসর নিতান্তই সীমিত। আমি এখানে শুধুমাত্র স্বীকৃত বিজ্ঞান প্রবন্ধ
এবং বিজ্ঞানের তথ্যের জন্য বিশ্বস্থ মাধ্যম থেকেই তথ্য নিয়েছি। কারো কাছে
আরো প্রয়োজনীয় কোন তথ্য থাকলে জানাতে পারেন। আমি এই লেখায় যোগ করে দেব।
স্বদেশে এখন জাগরণের সময়। দেশে না থাকতে পারার মত এত বেশি দুঃখ কখনো
হয়নি। স্বদেশের জাগরণে, ঘাতক খুনী রাজাকার এবং তাদের দল জামায়ত শিবির
মুক্ত বাংলাদেশের জন্য সারাবিশ্বে যাঁরা লড়ছেন তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
আমরা যেন সতর্ক থাকি, সুস্থ থাকি এবং স্বদেশের জন্য লড়াইয়ে কোন বিরতি না
নেই।
মানুষের জয় হোক।
Feb 28, 2013
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
সর্বাধিক পঠিত
বিভাগসমূহ
সংরক্ষণাগার
আমাদের কথা
Welcome to Bunagati 24.Com ।
Bunagati 24.com এর উদ্দেশ্য হল তথ্য ও প্রযুক্তি-কে সকলের নিকট সহজবোধ্য করা। পাশাপাশি অত্র এলাকাকে ইন্টারনেট জগতে আলোকিত করা।
এই সাইটটি আমাদের সকলের। তাই এটিকে আরও তথ্য সমৃদ্ধ দেখতে সকলের সহযোগিতা আবশ্যক।
অরাজনৈতিক ও রুচিসম্মত পোষ্ট সর্বদাই স্বাগত। এই সাইটটি এখন পরীক্ষামূলক ভাবে চলছে। সাইটটি পরিপূর্ণ করতে আপনাদেরমতামত ও পরামর্শ আবশ্যক।
bunagati@gmail.com
bunagati@yahoo.com
ধন্যবাদ
0 comments:
Post a Comment