ক্যান্সার শব্দটির সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত, কারন আমাদের মাঝে এমন খুব কমই পাওয়া যাবে যার কোনো না কোনো আত্মীয় বা দূর সম্পরকের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়নি, বা কখনও তার কাছে কেউ ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এসে সাহায্য চায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলও আমরা এই রোগটিকে সবচেয়ে অবহেলা করি। সোজা ভাষায় ক্যান্সার হলও এইডসের মতই একটি মরণব্যাধি, কিন্তু এইডসকে অতিরিক্ত ফ্ল্যাশ করতে গিয়ে এই রোগটি সম্পর্কে মানুষ অন্ধকারেই থেকে যায়।
ক্যান্সার মধ্যে আবার আছে ব্লাড/জরায়ু/স্তন/স্কিন বিভিন্ন ভিন্নতা, এগুলোর মধ্যে আমাদের দেশে ব্লাড ক্যান্সারের প্রকোপই বেশি, বাকিগুলো প্রকট হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনির্ণীত থাকে।
ব্লাড ক্যান্সার যা মেডিক্যাল ভাষায় লিউকেমিয়া হল রক্ত অথবা অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। এতে শ্বেতকণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিভাজন ঘটে।
লক্ষন সমুহ : রক্তের তথা ব্লাড ক্যান্সারের অন্যতম সমস্যাই হলো এর সুনির্দিষ্ট লক্ষণ ধরা যায় না, মানুষটি পুরুপুরি সুস্থ, অথচ পরদিনই তার রিপোর্টে ক্যান্সার ধরা পড়লো, অর্থাৎ রোগী নিজেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন না যে তিনি কি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত !
আরো কিছু লক্ষণ
ঘন ঘন জ্বর হওয়া (এটা সবচেয়ে কমন লক্ষ্মণ)
রাত্রিকালীন প্রচুর ঘামানো
প্রচন্ড দুর্বলতা ও অবসাদ
খিদে না থাকা ও ওজন হ্রাস
মাড়ি ফোলা বা খেতে থেতে রক্তক্ষরণ
ছোট কাটা ছিড়া থেকে অনেক রক্তক্ষরণ
স্নায়বিক লক্ষণ (মাথাব্যাথা)
স্ফীত যকৃত ও স্প্লীন সংক্রমণ হওয়া
অস্থিতে যন্ত্রণা, গাঁটে ব্যাথা, স্ফীত টনসিল
কারণ :
কোনো প্রকার লিউকেমিয়ার জন্যই কোনো নির্দিষ্ট একটি কারন নেই। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন লিউকেমিয়া হয়, এবং সেই কারণগুলোও ঠিকমত জানা নেই। গবেষকদের ধারনা অনুসারে নিম্নবর্তী চারটি কারণ সবথেকে সম্ভাব্যঃ
প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম আয়ন বিকিরণ
কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ
কিছু ভাইরাস
জিনগত যা কিছুটা জম্মগত
আমাদের এই কারনগুলো নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে, বিশেষ করে যারা স্বল্প শিক্ষিত, তার এই রোগের পিছনে রোগীর অপকর্ম খুজে বেড়ান। এতটুকু অনুরোধ এতটা অবিচার একজন ক্যান্সার রোগীর সাথে করবেন না। এই রোগের কোনও সুনির্দিষ্ট কারন আজ পর্যন্ত গবেষকরা এতো গবেষণা করেও বের করতে পারেন নি, এমনকি ধূমপানের সাথেও ব্লাড ক্যান্সারের সরাসরি কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
ডায়াগনসিস
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকিমিয়া চিন্হিত করার জন্য কিছু পরীক্ষা করা হয়। রক্তের কোষ পরীক্ষা (CBC), বায়োপসি বা হাড়ের মজ্জা পরীক্ষার (Bone Marrow Study) মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার চিন্হিত করা হয়।
আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে যাদের উপরের কোনও লক্ষ্মণ থাকবে তারা CBC টেস্টটা করাবেন, সরকারীতে ১৫০/২০০ টাকা খরচ হবে, আর যেকোনো ডায়গনিস্টিক সেন্টারে ৪০০ টাকা লাগবে
চিকিৎসা
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকিমিয়ার চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, কোন ধরনের ক্যান্সার, ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ের উপর। চিকিৎসা পদ্ধতির ভেতর আছে কেমোথেরাপি ( কিছু ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয় ), রেডিও থেরাপি (যন্ত্রের মাধ্যমে রেডিও ওয়েভ ব্যাবহারের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয়),হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন ইত্যাদি।
প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা গেলে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকিমিয়া সম্পূর্ন সেরে যায়।
যতটা সহজে বললাম সম্পূর্ন সেরে যায়, ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়, কারন প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়াটায় সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ, আমাদের মত অনুন্নত দেশতো দুরের কথা উন্নত দেশগুলোতেই রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পরার হার খুবই হতাশাজনক, এর কারন আগেই বলেছি রোগী নিজেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন না যে তিনি কি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত।
অধিকাংশ রোগীর জন্যই তাই হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন ( Bone Marrow Transplantetion) বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। কিন্তু Bone Marrow Transplantetion এর কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই, এটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যায়সাপেক্ষ একটি চিকিৎসা। আমাদের জন্য এই রোগের চিকিৎসা ব্যয় সবচেয়ে কম হয় ভারতে; তবে সেখানেই ব্যয় হয় প্রায় ৩০-৪০ লক্ষ টাকা।
কাজেই আমাদের দেশের ক্যান্সার রোগীরা আসলে তার আসল চিকিৎসাটাই নিতে পারেন না, যেটা কিছু রোগী নিতে পারেন তা হলও কেমোথেরাপি যাকে অন্য ভাষায় বিষথেরাপি বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না কারন কেমোথেরাপিতে আপনি কতগুলো বিষ আপনার শরীরে প্রবেশ করাবেন যা ক্যাসার সেলকে ধ্বংস করে, কিন্তু পাশাপাশি কিছু কোষকেও নষ্ট করে।কিন্তু নির্মম হলেও সত্য এর কোনও উপায়ও নেই।
আমাদের করনীয়
ক্যান্সার শুধু একটি জীবন শেষ করে দেয় তা নয়, এটি অনেক সময় একটি পরিবারকেও ধ্বংস করতে পারে, Bone Marrow Transplantetion বাদই দিলাম, শুধুমাত্র কেমোথেরাপির জন্যই একজন রোগীর নুন্নতম ৫-৬ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। আমাদের মধ্যে এরকম কমই পাওয়া যাবে যার কাছে কেউ কোনও দিন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চান নি, পত্রিকায়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আমাদের কোনও সহপাঠি হয়ত সাহায্যের জন্য এসেছিল। কিন্তু শুধু রোগটির সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার কারনে আমরা অবহেলা করেছি। ক্যান্সার চিকিৎসা আমাদের মত দেশে কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেই এককভাবে চালানো কষ্টকর।
ক্যান্সার চিকিৎসায় আমরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে না পারি কিন্তু আমরা রক্ত দিয়ে কিন্তু সাহায্য করতে পারি। একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন পড়তে পারে। আসুন আমরা নিয়মিত রক্তদান করি, এতে আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু একদিন আপনিই এই ভেবে গর্বিত হবেন যে আপানার রক্তে একটি জীবন বেঁচে ছিল।