১১ সংখ্যাটার দিকে তাকালেই আমার কেন যেন মনে হয়, দুজন একলা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি, অনন্তকালের জন্য। দুজন কিন্তু মুখোমুখি তাকিয়ে নেই- কিসের যেন অভিমান তাদের মাঝে, তবু ভালোবাসার আবেশেই তারা রয়ে গেছে পাশাপাশি...! ১১ সংখ্যাটাকে অসম্ভব ভালো লাগত অনেকদিন থেকেই।
কিন্তু এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় সংখ্যা এটা ঘোষণা দেওয়া হয় নি কখনও। আমার খুব কাছের বন্ধু তন্ময় যখন ঘোষণাটা দিয়েই ফেলল যে তার সবচেয়ে প্রিয় সংখ্যা ১১, তখন মনে হলো ওর চেয়ে আমার আসলে গাণিতিক অধিকার বেশি! তাই আমিও প্রচার করে দিলাম ১১ আমারও সবচেয়ে প্রিয়পূর্ণসংখ্যা। এখানে বলে রাখি, সব সংখ্যার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো পাই। পাইকে নিয়েও গল্প হবে, লিখতে যখন শুরু করেছি, সবার কথাই বলব ধীরে ধীরে।
কেন ভালবাসি ১১ কে?
ক) ১১ একটি মৌলিক সংখ্যা।
খ) ১১ খাঁটি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে!
গ) ১১ দিয়ে যেকোন সংখ্যাকে সহজেই গুণ করা যায়,
ঘ) ১১ দিয়ে ভাগ করলে দারুন একটা প্যাটার্ন পাওয়া যায়,
ঙ) ১১ দিয়ে বিভাজ্যতার নিয়মটা বেশ মজার,
চ) ১১ দিয়ে মজার সব খেলা দেখানো যায়,
ছ) ১১ এর সূচকগুলো প্যাসকেলের ত্রিভুজ মেনে চলে...
জ) ১১ তে আমি আমার আপন মানুষকে আরো আপন করে পেয়েছিলাম... :p
এমন আরও চমৎকার সব বৈশিষ্ট্য আছে ১১ সংখ্যাটির । তাই বলে তুমি যদি ভাবো, এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য ১১ কে ভালোবাসি, ভুল ভাবছ। ভালোবাসার জন্য বড় কারণ থাকতে হয় না, ভালোবাসার তাগিদেই ভালোবেসে যাওয়া যায়।ভালোবাসার পরিমাপ যতখানি যোগ্যতায় তার চেয়ে বেশি অনুভূতির তীব্রতায়। এই গুণগুলো হয়তো ভালোবাসাকে প্রেরণা জুগিয়ে যায়...।
যাহোক, ১১ এর সব কথা তো আমিও জানি না। যে ক'টা জানি, তার কয়েকটা এবারে বলে ফেলি।
ক) ১১ একটি মৌলিক সংখ্যা- মৌলিক সংখ্যাগুলোর সৌন্দর্যে মোহিত হন নি এমন গণিতবিদ পৃথিবীতে মনে হয় খুব কমই আছে। ১১ হলো পৃথিবীর ৫ নম্বর মৌলিক সংখ্যা (৫ সংখ্যাটাও দারুণ, এটা নিয়ে আগের নোটে বলেছি)।
খ) ১১ খাঁটি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে! একদিন ক্যালকুলেটরে ইচ্ছেমতো একটা সংখ্যাকে আরেকটা সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ভাগফলের দশমিকের পরের অংশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভালো লাগত। তো একদিন দেখি দশমিকের পর ০৯০৯০৯... এই রকম এসেছে। দেখে মজা লাগল, কারণ এটাকে পড়া যায় 'শূন্য নয়, শূন্য নয়, শূন্য নয়...' এভাবে। লক্ষ করলাম, ১ কে ১১ দিয়ে ভাগ দিলে এমন পাওয়া যায়। তখন বানিয়ে ফেললাম আমার 'সত্যবাদী সংখ্যা'। .বলো দেখি ১ কে ১১ দিয়ে ভাগ দিলে এটা কি কখনও শূন্য হবে, অবশ্যই না, কখনই না। ভাগফলও এই কথাটাই বলে,
১/১১= ০.০৯০৯০৯০৯... সে সারাজীবন বলতে থাকে এটা কিন্তু শূন্য নয়, শূন্য নয়, শূন্য নয়...
এটা ছিল আমার প্রথম কথা বলা সংখ্যা। দ্বিতীয়টার আবিষ্কার হঠাৎ করেই। সেটা ছিল সম্ভবত চতুর্থ গণিত ক্যাম্প। হয়েছিল মোহাম্মদপুরে। আমাকে বিনোদন গণিতের উপর একটা ক্লাস নিতে বলা হলো। আমি কথা বলা সংখ্যা পড়াচ্ছি, সত্যবাদী সংখ্যার কথা বলে ফেলেছি।
তখন মাথায় আসল, আমি যদি ২ কে ১১ দিয়ে ভাগ করি- কী পাব? দেখলাম ০.১৮১৮১৮১৮... এক আট,এক আট, এক আট... একটু জোরে পড়তে গিয়ে খেলে গেল দুষ্টুমি। বের হয়ে গেল বাংলা ভাষার সবচেয়ে লোভী সংখ্যা। জোরে জোরে পড়লে শোনাবে এমন... শূন্য দশমিক একআটএকাট্যাকাট্যাকা ট্যাকা ট্যাকা।
গ) ১১ দিয়ে কোন সংখ্যাকে গুণ করা খুবই সোজা। প্রথমে দুইক অঙ্কের সংখ্যার কথা বলি। আস্তে আস্তে আরও বড় সংখ্যার জন্য বলা যাবে। আগে ভালো করে তাকাও, নিজেই বুঝে যাবে অনেক কিছু, বাকিটা আমি বুঝিয়ে দেব।
১১ x ২৩= ২৫৩
১১ x ৫৪= ৫৯৪
১১ x ৭২= ৭৯২
একটু ভালো করে তাকালেই দেখতে পাবে , আমি যা করেছি তা খুব সোজা, দুই অঙ্কের যেই সংখ্যার সাথে ১১ কে গুণ করবে, সেটাকে ভেঙ্গে আলাদা কর, তারপর মাঝখানে অঙ্ক দুইটার যোগফল বসিয়ে দাও। যেমন ৫৪ এর ক্ষেত্রে দুইপাশে ৫ আর ৪ লিখে মাঝে এদের যোগফল ৯ বসিয়ে দাও, শেষ !
এখন একটু ঝামেলায় পড়বে যদি অঙ্ক দুইটার যোগফল ১০ এর বেশি হয়। এটার জন্য শুধু মনে রাখবে, মাঝের ঘরে জায়গা আছে শুধু একটা। হাতে যা থাকবে তা বামের ঘরে চলে যাবে। বুঝিয়ে দেই? ধর- ১১ x ৮৫ বের করবে। এখন ৮ আর ৫ কে আলাদা করে লিখলে, ভালো কথা। মাঝে কত হবে। ৮ আর ৫ যোগ করলে তো হয় ১৩, কিন্তু মাঝে ঘর আছে একটা ।
(৮+১) ৩ ৫ ,
তাই ১৩ এর ৩ মাঝের ঘরে থাকবে আর হাতের এক বামের ৮ এর সাথে গিয়ে হবে ৯। .উত্তর ৯৩৫। .এভাবে ১১ x ৬৮= (৬+১) ৪ ৮= ৭৪৮ , ১১ x ৯৮= (৯+১) ৭ ৮= ১০৭৮।
কেন এমন হলো সেটা বোঝাটাও খুব সোজা। ছোটবেলায় উপরে নিচে লিখে লিখে আমরা খুব সহজে যে গুণ করতাম সেটা দেখলেই বোঝা যাবে এটা। নিচে ১১ রেখ, তাহলে সহজে বুঝবে। যেমনঃ
৭ ২
X ১ ১
------
৭ ২
৭ ২ X
------
৭ ৯ ২, ভালো করে মাঝের ঘরটা দেখ, ৭ আর ২ কত আনন্দ নিয়ে যোগ হয়ে গেছে! অঙ্ক দুটোর যোগফল ১০ এর বেশি হলে কেন অমন ঝামেলা হয়, সেতাও এভাবে গুণ করে সহজেই বোঝা যায়। আচ্ছা, যার সাথে ১১ কে গুণ করছি সেটা যদি দুই অঙ্কের চেয়ে বড় হয়? তখন ‘লাফাইন্যা পদ্ধতি’ ব্যবহার করে সহজেই গুণ করা যাবে। এটা আবার কেমন সেটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ২৩৪১৬ x ১১ = ? এর উত্তর হলো ২৫৭৫৭৬ । .কিভাবে হলো? প্রথমে প্রথমটা অর্থাৎ ২ নাও। এরপর দুটো করে নিয়ে নিয়ে যোগ করতে থাকো যেমন ২ আর ৩ এ ৫, ৩ আর ৪ এ ৭, ৪ আর ১ এ ৫, ১ আর ৬ এ ৭ আর শেষে শেষেরটা মানে ৬ , শেষ? এটাও পাওয়া যায় বাচ্চাদের মতো গুণ করে। আর যদি মাঝে কোন দুইটা যোগ করে ১০ এর বড় হয়ে যায়? আগের মতো বামের ঘরে নিয়ে যাবে!
ঘ) ভালো করে দেখ তো কোন নামতা নামতা গন্ধ পাও কিনা?
১/১১= ০. ০৯ ০৯ ০৯ ০৯ ০৯... ...
২/১১= ০. ১৮ ১৮ ১৮ ১৮ ১৮... ...
৩/১১= ০. ২৭ ২৭ ২৭ ২৭ ২৭... ...
৪/১১= ০. ৩৬ ৩৬ ৩৬ ৩৬ ৩৬... ...,
সবাই আশা করি বুঝে গেছ, ভাগফলের ভিতরে ৯ এর নামতা আছে। তাহলে ধারণা কর তো ৮/১১ কত? হুম, আট নং বাহাত্তুর। সুতরাং এটা হবে, ০. ৭২ ৭২ ৭২ ৭২ ৭২... ...
পৃথিবীর যেকোন সংখ্যাকে ১১ দিয়ে ভাগ করলে হয় সেটা নিঃশেষে বিভাজ্য হবে, নয়তো দশমিকের পরে ঠিক এই ৯ এর নামতাই আসবে। ভাগশেষ যা হবে, তাকে ৯ দিয়ে গুণ করলেই দশমিকের পর অনন্তকাল কি কি আসবে সব বলে দেয়া যাবে (ভাগশেষ ৬ হলে .৫৪ ৫৪ ৫৪ ৫৪... ... এমন)। .এমন কেন হল, সেটা বুঝবে যদি ৯৯ কে ঠিকঠাক চিনতে পার ! দুই অঙ্কের যেকোন সংখ্যাকেই যদি ৯৯ দিয়ে ভাগ করা হয়,ঐ দুটো সংখ্যাই বারবার আসে। যেমনঃ
২৩/৯৯=০.২৩ ২৩ ২৩ ২৩ ২৩... ...
৫৭/৯৯=০. ৫৭ ৫৭ ৫৭ ৫৭ ৫৭... ... , দারুণ , তাই না?
এটা কেন হয়, সেটা সামান্য অঙ্ক কষে বলা যায়। ধর দশমিকের পর শুধু এমন প আর ফ , পফ বারবার আসছে। ভগ্নাংশ আকারে লিখলে ওটাকে দেখতে কেমন লাগবে, সেটা দেখতে চাই। ধরা যাক ঐ সংখ্যাটার নাম ক।
ক = ০. পফ পফ পফ পফ পফ... ... এটাকে দুইপাশে ১০০ দিয়ে গুণ করলে পাব,
১০০ক = পফ . পফ পফ পফ পফ ... ... এই ১০০ক থেকে একটা ক বাদ দিলে হবে,
(-)ক = ০. পফ পফ পফ পফ ... ...
---------------------------------
৯৯ ক = পফ
ক=পফ/৯৯ । .এটার মানেই হলো যেকোন দুই অঙ্কের সংখ্যাকে ৯৯ দিয়ে ভাগ করলে ঐ সংখ্যাটাই বারবার আসবে।
এখন মনে আছে, আমি বলেছিলাম ৪/১১= ০. ৩৬ ৩৬ ৩৬ ৩৬... ... এবারে এটার মাহাত্ম্য তোমরা বুঝবে। ৪/১১= (৪ x ৯)/(১১ x ৯)= ৩৬/৯৯ । .ভগ্নাংশের উপরে নিচে একই সংখ্যা দিয়ে গুণ তো করাই যায়। আর ৩৬/৯৯ আর কতই বা হবে, নিচে ৯৯ থাকলে যা হয়! . ৩৬ ৩৬ ৩৬ ৩৬... ...
ঙ) একটা সংখ্যা ১১ দিয়ে ভাগ যায় কিনা, সেটা বোঝার উপায়টা বেশ মজার। ২২, ৩৩,৪৪ এরা যে ১১ দিয়ে বিভাজ্য, সেটা তো আমিই বুঝতে পারি! কিন্তু অনেক বড় সংখ্যা হলে। আমি যেমন আরেকটা বুঝতে পারি, যদি সংখ্যাটা জোড় ঘর বিশিষ্ট হয় (৪ অঙ্ক বিশিষ্ট , ৬ অঙ্ক বিশিষ্ট এমন) এবং যদি ওটাকে উলটা করে লিখলে একই থাকে, সেটাও ১১ দিয়ে বিভাজ্য। যেমনঃ ৩৭৮৮৭৩, ২৬৮০০৮৬২ এরা ১১ দিয়ে বিভাজ্য। এবার একটা সার্বজনীন নিয়ম। যেই সংখ্যাটাকে পরীক্ষা করতে চাই, সেটার জোড় স্থানের অঙ্কগুলো একবার যোগ কর আর বিজোড় স্থানের অঙ্কগুলো একবার যোগ কর। যেমন ধরা যাক ৭১৮০৯১।
একটা করে পরপর নিয়ে নিয়ে যোগ কর। ১+০+১=২।
আর বাকি গুলো যোগ করলে হয় ৭+৮+৯=২৪।
এখন এদের বিয়োগফল যদি ১১ দিয়ে বিভাজ্য হয়, তাহলে পুরো সংখ্যাটাই ১১ দিয়ে বিভাজ্য। এখানে এদের বিয়োগফল ২৪-২=২২, যা ১১ দিয়ে বিভাজ্য। তাহলে পুরো সংখ্যাটাও ১১ দিয়ে বিভাজ্য হবে।
আরেকটা উদাহরণ দেখলে নিয়মটা পরিষ্কার হবে। ২৯৬৭৩৮১৪৫ সংখ্যাটা ১১ দিয়ে বিভাজ্য কিনা পরীক্ষা করতে চাই। এখন ২+৬+৩+১+৫=১৭, আর ৯+৭+৮+৪=২৮।
এদের বিয়োগফল ১১, যা ১১ দিয়ে বিভাজ্য। সুতরাং এই বড় সংখ্যাটাও ১১ দিয়ে বিভাজ্য।এটা কেন হয়, সেটা বোঝাব অন্য একটা নোটে (এই পোস্টে আর জায়গা নাই)
চ) একটা খেলা দেখানো যাক। প্লিজ একটা খাতা কলম নাও, প্লিজ !
১. তিন অঙ্কের যেকোন একটা সংখ্যা নাও, যার তিনটা অঙ্ক আলাদা আলাদা। ০ কে নিও না। (১৫৪, ৭৮৯ এমন যেকোন কিছু হতে পারে , কিন্তু ২২৩, ৯০৩ এমন কিছু নিও না)।
২. তিনটা অঙ্কের যোগফল নাও। একে দুই দিয়ে গুণ কর। যা পেয়েছ সেটাকে খাতার কোণায় ছোট একটা চারকোণা বাক্স এঁকে তার মধ্যে লিখে রাখ।
৩. এই তিনটা অঙ্ক দিয়ে দুই অঙ্ক বিশিষ্ট যতগুলো সংখ্যা বানানো যায় সব বানাও (একই অঙ্ক দুবার ব্যবহার করো না!), মোট ৬ টা এমন সংখ্যা পাবে। বুঝিয়ে দিই। ধর তুমি ১৫৪ ধরেছ। সেক্ষেত্রে তুমি বানাতে পারবে ১৫,৫১,১৪,৪১,৫৪,৪৫ এই ছটি সংখ্যা।
৪. এই ছ’টা সংখ্যা যোগ কর। (এদেরকে যোগ করতে কষ্ট পেও না, এরা খুবই ছোট সংখ্যা, মুখে মুখে বা খাতায় লিখে খুবই দ্রুত যোগ করে ফেলতে পারবে)।
৫. এই যোগফলকে একটু আগে খাতার কোণায় বাক্সে যে সংখ্যাটা লিখে রেখেছ সেটা দিয়ে ভাগ দাও।
আমি জানি আপনার উত্তর কত এবং আমি এও জানি আপনি বুঝতে পেরেছেন যে আমি আসলেই জানি, তাকে নিয়েই তো আজকের এই আয়োজন!
0 comments:
Post a Comment